বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পাটশিল্পের ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবময়। একসময় পাটকে বলা হতো “সোনালি আঁশ,” যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি মূল চালিকা শক্তি হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাটকলগুলির দুরবস্থা ও বেসরকারিকরণের নানাবিধ চক্রান্ত প্রশ্ন তুলেছে: এই শিল্পটিকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়ার পেছনে আসলে কী কুমতলব কাজ করছে?
পাটকলগুলির বেসরকারিকরণের প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সরকারের অধীনে পাটকলগুলো জাতীয়করণ করা হয়। এটি করা হয় যাতে শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত হয় এবং দেশীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা যায়। কিন্তু বেসরকারিকরণের প্রথম ধাপ শুরু হয় ১৯৮০-এর দশকে, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থা আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের তাগিদে। তাদের মতে, সরকারি পাটকলগুলো উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিচ্ছে এবং এটি সরকারের অর্থনীতিতে বোঝা সৃষ্টি করছে।
বেসরকারিকরণের কুমতলব: একটি চক্রান্তমূলক পরিকল্পনা?
বেসরকারিকরণের নামে পাটকলগুলো ধ্বংসের উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে অনেক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন। এর পেছনে কিছু কারণ হতে পারে:
বিদেশি পণ্যের প্রতি আসক্তি: সস্তা কৃত্রিম তন্তুর জনপ্রিয়তা এবং প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার ফলে পাটজাত পণ্যের চাহিদা কমেছে। ফলে পাটকলগুলিকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
রাজনৈতিক সুবিধাবাদ: অনেক সময়, রাজনৈতিক নেতারা এবং তাদের অনুগত শিল্পপতিরা এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পদ অধিকার করার জন্য পাটকলগুলিকে ব্যক্তিমালিকানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এতে স্থানীয় শ্রমিক শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ধনী শিল্পপতিরা লাভবান হন।
বৈদেশিক চাপ ও দাতা সংস্থার প্রভাব: আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলি প্রায়ই উন্নয়নশীল দেশগুলিকে বিভিন্ন প্রস্তাব দেয়, যা কিনা দেশের বাস্তবতার সাথে খাপ খায় না। এ প্রেক্ষাপটে, আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনায় পাটকলগুলো বেসরকারিকরণের দিকে ধাবিত করা হয়।
পাটকল ধ্বংসের ফলাফল
বাংলাদেশের পাটশিল্পের অবস্থা এখন শোচনীয়। বহু শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন, তাদের জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য গুরুতর সংকটের কারণ হতে পারে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায়
পাটশিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নিতে হবে:
সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং প্রযুক্তির ব্যবহার: নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা চালু করে পাটকলগুলির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব।
বিশ্ববাজারে সঠিক বিপণন: বিশ্বব্যাপী পরিবেশবান্ধব পণ্যগুলির চাহিদা বেড়েছে। তাই বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যগুলিকে সঠিকভাবে বিপণন করে রফতানি বাড়ানো যেতে পারে।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রণোদনা: সরকারিভাবে পাটকলগুলিকে প্রণোদনা দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিতে হবে এবং শ্রমিকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার
বাংলাদেশের পাটকলগুলির বেসরকারিকরণের চক্রান্ত আমাদের সোনালী ইতিহাসের অংশটিকে ধ্বংস করছে। সময় এসেছে এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে পাটশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শ্রমিক শ্রেণীর সুরক্ষার জন্য পাটশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি।