বাংলাদেশের চিকিৎসা খাত জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, এই খাতের নানা স্তরে দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবার দুর্নীতি না শুধুমাত্র চিকিৎসার মান কমিয়ে দিচ্ছে, বরং এতে রোগীর ওপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপও পড়ছে। তাই, চিকিৎসা খাতের এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। এই প্রবন্ধে চিকিৎসা খাতের দুর্নীতি, এর কারণ, প্রভাব এবং এর প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হবে।
চিকিৎসা খাতের দুর্নীতি কী এবং কেন তা বিপজ্জনক?
চিকিৎসা খাতের দুর্নীতি বলতে চিকিৎসা সেবা প্রদানে অবৈধ বা অনৈতিক কার্যক্রম বোঝায়। এটি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে যেমন: অবৈধ কমিশন গ্রহণ, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের দুর্নীতি, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা, রোগীর থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় এবং সরকারি চিকিৎসা সুবিধা থেকে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করা। চিকিৎসা খাতের দুর্নীতি বিপজ্জনক কারণ এটি শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং জীবন-মৃত্যুর মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে জনজীবনে বড় প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতে দুর্নীতির কারণসমূহ
১. স্বাস্থ্য বাজেটের অপ্রতুলতা ও মনিটরিংয়ের অভাব
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বাজেট তুলনামূলকভাবে কম, ফলে পর্যাপ্ত উন্নতি করা সম্ভব হয় না। এছাড়া, তহবিলের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাব থাকায় প্রায়ই তহবিল অপচয় ও দুর্নীতি ঘটে।
২. কমিশন বাণিজ্য ও ডাক্তার–ফার্মাসি যোগসাজশ
বাংলাদেশে অনেক ডাক্তার ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন গ্রহণ করেন। এতে তারা রোগীদেরকে অপ্রয়োজনীয় বা উচ্চমূল্যের ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেন। এই অপ্রয়োজনীয় ওষুধ রোগীর ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে এবং অনেক ক্ষেত্রেই রোগীদের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়।
৩. চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের সরবরাহে দুর্নীতি
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের সরবরাহে ব্যাপক দুর্নীতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধের অভাবে রোগীরা সরকারি সুবিধা না পেয়ে প্রাইভেট হাসপাতাল বা ফার্মেসি থেকে অতিরিক্ত দামে ওষুধ কিনতে বাধ্য হয়।
৪. বেসরকারি হাসপাতালগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও লাইসেন্সিংয়ের দুর্বলতা
বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে প্রায়ই বিনা লাইসেন্সে কাজ করা হয়, এবং পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ ও মান নিয়ন্ত্রণের অভাবে সেবার মান অত্যন্ত খারাপ হয়। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ছাড়াই অনেক কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়, যার ফলে রোগীরা ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসার শিকার হন।
৫. প্রভাবশালী মহলের অসৎ উদ্দেশ্য ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চিকিৎসা খাতে প্রভাবশালী মহল ও রাজনীতির কারণে অনেক সময় দুর্নীতি প্রকাশ পায় না। প্রশাসনিক পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রভাব ও পক্ষপাতিত্বের কারণে সঠিক আইন প্রয়োগে সমস্যা হয়, যা দুর্নীতির মাত্রা আরও বাড়িয়ে তোলে।
চিকিৎসা খাতে দুর্নীতির প্রভাব
১. স্বাস্থ্যসেবার মান হ্রাস
দুর্নীতির ফলে স্বাস্থ্যসেবার মান দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পাওয়া, অবৈধ ওষুধ ব্যবহার এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি রোগীদের স্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে তুলছে।
২. রোগীদের আর্থিক ক্ষতি
দুর্নীতির ফলে রোগীরা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা, অতিরিক্ত মূল্য আদায়, এবং উচ্চ মূল্যের ওষুধ ক্রয়ে বাধ্য হয়। ফলে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষজন চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে সমস্যায় পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়।
৩. জনগণের আস্থা হ্রাস
দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। অনেকেই সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে প্রাইভেট হাসপাতালের দিকে ঝুঁকছে, যা তাদের উপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে।
৪. মানবিক অধিকার লঙ্ঘন সবার জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া একটি মৌলিক অধিকার। তবে দুর্নীতির কারণে দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়। এতে তাদের জীবন ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে এবং দেশের সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
চিকিৎসা খাতের দুর্নীতি প্রতিরোধে করণীয় পদক্ষেপসমূহ
১. স্বাস্থ্য বাজেট বাড়ানো এবং কার্যকর তদারকি
চিকিৎসা খাতে বাজেট বাড়িয়ে তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কার্যকর তদারকি প্রয়োজন। বাজেটের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে একটি স্বচ্ছ তদারকি কমিটি গঠন করা উচিত, যারা চিকিৎসা খাতে খরচ এবং প্রয়োজনীয়তার উপর নিয়মিত পর্যালোচনা করবে।
২. ডাক্তারদের পেশাগত সততা নিশ্চিত করা
ডাক্তারদের পেশাগত সততা বজায় রাখতে অনৈতিক কমিশন বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। এ জন্য ডাক্তারদের প্রতি নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যা তাদের কমিশন গ্রহণ এবং অনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করবে।
৩. বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ
বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে সঠিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে। এদের লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া, মান নিয়ন্ত্রণ এবং পরিষেবার খরচ নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা আরও জোরদার করতে হবে।
৪. প্রভাবশালী মহল ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমানো
প্রশাসনিক নিয়মাবলী মেনে চিকিৎসা ব্যবস্থা পরিচালনা করতে হবে এবং এর জন্য প্রভাবশালী মহল বা রাজনৈতিক শক্তির হস্তক্ষেপ বন্ধ করা প্রয়োজন। একটি নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করা উচিত, যারা চিকিৎসা খাতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে।
৫. দুর্নীতি দমন কমিশনের সক্রিয় ভূমিকা
দুর্নীতি দমন কমিশনকে চিকিৎসা খাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও সক্রিয় হতে হবে। তারা বিভিন্ন স্তরে তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে পারে।
৬. জনগণের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করতে গণমাধ্যম এবং এনজিওগুলোর সাথে অংশীদারিত্ব করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। চিকিৎসা সংক্রান্ত অধিকার সম্পর্কে মানুষকে জানানো হলে তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ হবে।
উপসংহার
বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতে দুর্নীতির প্রভাব দিন দিন বাড়ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জনগণের সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এই খাতের দুর্নীতি প্রতিরোধে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। বাজেট বাড়ানো, কমিশন বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, বেসরকারি হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ, এবং জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়ক হবে।
যদি সরকার ও জনগণ মিলিতভাবে এই উদ্যোগে এগিয়ে আসে, তবে বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব হবে এবং সকলের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে।